বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

“একাত্তরের জল্লাদ-সাতক্ষীরার আব্দুল খালেক মণ্ডল”

আজ আপনাদের "রাজাকার আব্দুল খালেক মণ্ডল" এর কুকর্ম সম্পর্কে বলছি ! কষ্ট করে পরবেন আশা করি .!.


“একাত্তরের জল্লাদ-সাতক্ষীরার আব্দুল খালেক মণ্ডল”





মহান মুক্তিযুদ্ধকালে সাতক্ষীরা জেলা শান্তি কমিটির সভাপতির দায়িত্বে ছিল জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মাওলানা আব্দুল খালেক মন্ডল। সদর উপজেলার খলিলনগর গ্রামের লুতফর রহমান মন্ডলের(লালচাঁদ মন্ডল) পুত্র খালেক স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতা করা ছাড়াও মেতে উঠেছিল বাঙালি নিধনে। হত্যা, ধর্ষন, লুন্ঠন, হিন্দুদের নির্যাতনসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা সে করেনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়।প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, খান সেনাদের ক্যাম্পে নারী সরবরাহ, প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির বাড়ি দখল, অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হত্যাসহ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পৈশাচিকভাবে নরহত্যার মতো অপরাধ করেছে আবদুল খালেক মণ্ডল। এ কারণেই ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ তার উপাধি দিয়েছিল 'জল্লাদ খালেক'।



নিজ গ্রামের মঞ্ছুর আলি সরদার, কাথন্ডার হিমেপান্তি, বলদঘাটা গ্রামের সামসুর রহমান, অহেদ'কে তার নেতৃত্বে পাকবাহিনীর বৈকাবী ক্যাম্পে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। বাশিয়াপাড়ার তাহের আলীর ছেলে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় খালেক মন্ডল তাকে দাঁতভাঙা বিল থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খালেক মন্ডল পাকবাহিনীকে নারী সরবরাহের ভুমিকা পালন করে। খালেক বাহিনী কাথন্ডা গ্রামের শহর আলি দফাদার, মোহর আলি দফাদার, বদরুজ্জামান মল্লিক, আব্দুর রাজ্জাক সরদার ও দেলোয়ার হোসেন সরকার সহ ৭ মুক্তিযোদ্ধাকে বৈকাবী ক্যাম্পে ধরে এনে উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হলেও সে যাত্রায় তারা প্রানে বেঁচে যান। তার নেতৃত্বে কাথন্ডা গ্রামের আবুল হোসেন গাজীকে রাজাকাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।

২৫ মার্চ খান সেনারা কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা যশোর থেকে দলে দলে নানা বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশুরা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে তারা সাতক্ষীরাকে বেছে নেন ট্রানজিট রুট হিসেবে। সাতক্ষীরার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসব আগত কান্ত, শ্রান্ত ও অভুক্ত লোকদের অভ্যর্থনা জানায় এবং টাউন হাইস্কুলের (বর্তমানে সাতীরা সরকারী বালক বিদ্যালয়) বিভিন্ন কক্ষে তাদের দু’একদিন থাকার ব্যবস্থা করেন। রাতের অন্ধকারে পাকসেনা ও তাদের দোসররা আশ্রিত মানুষের ওপর আক্রমণ করে। সেদিনের তারিখটি ছিল ২০ এপ্রিল। এই ভয়াবহ গনহত্যা সংঘটিত হয় খালেক মন্ডলের নেতৃত্বে । ওই হত্যামিশনে সেখানে আশ্রয় নেওয়া শত শত শিশু নারী পুরুষ যারা ভারতে শরনার্থী হিসাবে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল তাদের নৃশংসভাবে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে খালেক বাহিনী। এলাকায় বহুস্থানে বাঙ্কার করে সেখানে নিরপরাধ মানুষকে হত্যাশেষে মাটিচাপা দেয় এই খালেক বাহিনী। খালেক মন্ডল বাঙ্কার খুড়তে নির্দেশ দিলে, সে নির্দেশ পালনে অস্বীকার করায় মুক্তিযুদ্ধকালে নিজগ্রামের ঈমান আলীকে গুলি করে হত্যা করে রাজাকার খালেক বাহিনী।

শ্রীমতী আশালতা আমিন খালেক বাহিনীর টাউন হাইস্কুলের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বলেন , “১৩৭৮ সালের বোশেখের প্রথম সপ্তাহের মঙ্গলবার। সন্ধ্যার পর টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যার আগে ও পরে টাউন হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল ৪শ’ থেকে ৫শ’ নারী-পুরুষ ও শিশু। রাত ৯টার দিকে খানসেনারা টাউন হাইস্কুলের বিভিন্ন কে ঢুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ খুন করতে থাকে। বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে তারা খেলতে থাকে রক্তের হোলি খেলা। স্কুলের দোতলা থেকে শিশুদের ছুঁড়ে সামনের পুকুরে ফেলে দেয়া হয়। কিছু লোক পালিয়ে যায়। শ্রীমতী আশালতা আমিন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, সাতক্ষীরায় খান সেনারা যে পৈশাচিক কাণ্ড ঘটিয়েছে, তার পথ দেখিয়েছে কিছু বিপদগামী বাঙালি। আমি মৃত্যুর আগে এসব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যেতে চাই।”

টাউন হাইস্কুলের মাঠের উত্তর পাশে প্রায় ৫০ গজ দূরে কৃষক আবু বক্করের (৬২) বাড়ি। তিনি জানান, টাউন হাইস্কুলের বিভিন্ন কক্ষে আশ্রয় গ্রহণকারীদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। স্কুলের পিছনে যে মাটির দেয়াল ছিল সেখানে তাদের রাইফেলের বেয়নেটে খুঁচিয়ে, চাকু, দা, বটি দিয়ে কচুকাটা করা হয়েছে। তাদের লাশ এখানে মাটি চাপা দেয়া হয়। টাউন হাইস্কুলে আশ্রয়গ্রহণকারী নিরীহ মানুষকে বর্বর খানসেনারা যে বধ্যভূমি বানিয়েছিল তা ৪০ বছরেও ভুলবার নয়। আবু বক্কর বললেন, পাক আর্মিদের যেসব বাঙালি মীরজাফর ওই হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করেছিল এসব মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের নৃংশসতার বিচার চাই। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা খালেক মণ্ডল, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকি (অধ্যাপক আসাদুল্লাহ গালিবের ভাই), সাবেক ছাত্রসংঘের নেতা নুরুল বাসার, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল আলী, সাবেক ছাত্র সংঘের রোকনুজ্জামান, জহুরুল ইসলাম ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা রিয়াসাদ আলী প্রমুখ।


প্রয়াত সাংবাদিক সুনীল ব্যানার্জির ভাই কল্যাণ ব্যানার্জি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই খালেক মণ্ডল শহরের ফুড অফিস মোড়ে অবস্থিত আমাদের পৈতৃক বাড়িটি দখল করে নেয়। তবে বাড়ির পুরো অংশ জ্বালিয়ে দিলেও বাকি রেখেছিলেন একটি ঘর। সেখানে বসেই খালেক মণ্ডল শান্তি বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা করতো। প্রায় ৮ মাস ওই ঘরে থেকেই খালেক সঙ্গীদের নিয়ে আশপাশ এলাকায় চালিয়েছে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ।” তিনি জানান, তার তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বয়সে ছোট হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভীষিকাময় ঘটনার শিকার হয়েছেন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও খালেক মণ্ডলের বিচার হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।

এলাকাবাসী বলছেন, সাতক্ষীরার ইতিহাসে খালেক মণ্ডলই প্রথম কয়েদি। এলাকায় জল্লাদ খালেক নামে পরিচিত আব্দুল খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক ধর্ষণের অভিযোগ। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঘোনা গ্রামের এক গৃহবধূকেও ধর্ষণ করে এই খালেক। ওই গৃহবধূ কালের সাক্ষী হয়ে আজও জীবিত আছে। সে দিনের সেই পাশবিক নির্যাতনের কথা স্মরণ করলে শিউরে ওঠেন ওই মহিলা।


সাতক্ষীরা জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি নুরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, “একাত্তরে খালেক জল্লাদের নির্দেশেই হাজারো লোকের সামনে ঘোনা ইউনিয়নের মিরাজউদ্দিনের ছেলে তছিরকে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় ওয়াজেদ আলী দফাদারের স্ত্রী গোলে আরজানকে। তারা এখনও সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন। সাতক্ষীরার সব জনগণ যুদ্ধাপরাধী খালেক জল্লাদের ফাঁসি চায়।”


মুক্তিযুদ্ধে ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হওয়ার পর পালিয়ে যাওয়ার সময় কদমতলা ব্রিজের কাছে সে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়। অগনিত মানুষের প্রানসংহারী খালেক বন্দী হলেও প্রানভিক্ষা পায় এবং পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী থেকে সাংসদ হিসাবে জয়ী হয়। জেএমবির সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর শুরু হয় পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান। জেএমবি জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রথম শনাক্ত করা হয় সাতক্ষীরা থেকেই। কিন্তু সাবেক জামায়াত এমপি আবদুল খালেক মণ্ডলের অবৈধ হস্তক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযান। সাতক্ষীরা সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গোলাম মোহাম্মদ জঙ্গিবিরোধী অভিযানে প্রতিবন্ধকতার কারণে আবদুল খালেক মণ্ডলের বিরুদ্ধে ৭টি জিডি করেন। এর পরেও খালেক মণ্ডল থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। জোট শাসনামলে সরকারের ত্রাণের টিন খালেক মণ্ডলের নির্দেশনা অনুযায়ী জামায়াতের অনুগত বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিতরণ করার অভিযোগ ওঠে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন থেকে নির্বাচন করে মহাজোট প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়। তার বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা আগরদাড়ি মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগও আছে। পরে ওই টাকা সে সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বাধ্য হয়।

সুত্রঃ
১.সাপ্তাহিক ২০০০, ২৬শে ডিসেম্বর ২০০৮
২.দৈনিক সমকাল, ১ ডিসেম্বর ২০১১
৩. বাসস, ১৬ ডিসেম্বর ২০১১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন