রবিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার বিচারের রায় এবং কতিপয় প্রশ্ন

সেই সকাল থেকে উঠে প্রেসক্লাব আর আদালত চত্বরের সামনে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করছি। প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন আর মিছিল চলছে। রক্তে ফিরে এসেছে একাত্তর। ক্যামেরায় অসংখ্য ছবি তুলে রেখেছি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কখন রায় ঘোষিত হবে।  কখন শুনব ঘাতক কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হয়েছে। ভিয়েনা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সেফাতউল্লাহ ফোন করেছেন। বললেন, “দাদা, একচল্লিশ বছর ধরে এই দিনটার জন্য প্রতীক্ষায় আছি।” অনেকের মতোই মুক্তিযোদ্ধা সেফাতউল্লাহও নিশ্চিত, রায়ে কাদের রাজাকারের ফাঁসি হবেই।

অবশেষে রায় ঘোষিত হয়েছে। কাদের মোল্লার বিরূদ্ধে পাঁচটি অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তিনটি অপরাধের জন্য ১৫ বছরের জেল, আর দুটি অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাই, বিশেষ করে বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম, এই রায়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। আমাদের সবার প্রত্যাশা ছিল, বাচ্চু রাজাকারের মতো কাদের রাজাকারেরও ফাঁসির রায় হবে।

রায় ঘোষণার পর থেকেই একের পর এক মোবাইল ফোন বেজে চলছে। একবার মনে হলো, ফোনটা বন্ধ করে রাখি। পরে মনে হলো, বন্ধ রাখাটা কোনো সমাধান নয়; বরং মানুষের কথা শোনাটা জরুরি।
কেবল হতাশা নয়, আজকের রায়ে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে।

১. সবাই আশা করেছিল ফাঁসির রায় হবে, কেন হলো না?
২. গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কেন ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো লঘু শাস্তি দেয়া হলো?
৩. সরকার কি জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি আন্দোলন ও হুমকির মুখে ভয় পেয়ে পিছু হটল?
৪. সরকার কি জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে গোপন কোনো আঁতাত করেছে? যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এটি বিশ্বাস করি না, তবে এই আঁতাতের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে তা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী এক রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে অচিরেই প্রমাণিত হবে।

বাংলাদেশে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আসলে তেমন কোনো সাজাই নয়। সরকার পরিবর্তন হলেই এসব রাজাকার বুক ফুলিয়ে কারাগার থেকে বীরের বেশে বেরিয়ে আসবে বলেই অনেকের আশঙ্কা। এর আগে জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে খালেদা জিয়াও তাদের সসন্মানে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে আবার মন্ত্রী বানাবেন, তাদের গাড়িতে তুলে দেবেন অযুত শহীদ মুক্তিযোদ্ধার রক্তভেজা জাতীয় পতাকা।

আমি জানি না, এই রায় আইনের দৃষ্টিতে কতটা অনিবার্য ছিল। আমি জানি না, এর মধ্য দিয়ে গণ-আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বিচারের স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় অধিক মনোযোগী হওয়ার কোনো প্রয়াস ছিল কি না। এর পেছনে যে কারণ আর যুক্তিই থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের একজন সোচ্চার কর্মী হিসেবে এই রায় মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে।

আমি মানছি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, অর্থাৎ ৩০ বছরের কারাবাসও তুচ্ছ বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশে কাদের রাজাকারের যে ৩০ বছর কারান্তরালে কাটাতে হবে না, অতীত অভিজ্ঞতায় তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সবকিছু বিবেচনায় আমরা কাদের রাজাকারসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলসহ প্রসিকিউশনের কাছে জোর আরজি জানাচ্ছি, তারা যেন পূর্ণাঙ্গ রায় বিশ্লেষণ করে অচিরেই উচ্চতর আদালতে আপিল করেন। আমি এখনো বিশ্বাস করি, যেহেতু গণহত্যার মতো অপরাধসহ আরো কয়েকটি অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সেহেতু উচ্চতর আদালত বর্তমান রায় পরিবর্তন করে কাদের রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করবেন।

গণহত্যা, মানবতার বিরূদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো রায়ই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

দুই.
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় না হওয়ায় সমগ্র বাঙালি জাতি যেভাবে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে, তা দেখে শত কষ্টের মধ্যেও ভালো লাগছে। আজকের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি জাতি প্রমাণ করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডই তারা দেখতে চায়। আমরা আশা করব, আমাদের বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী প্রমাণিত অপরাধের সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে যেন গণ-আকাঙ্ক্ষার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখেন। আজ সারা দিন এই বিচার নিয়ে অনেক ভেবেছি। প্রতিবাদ সমাবেশে গিয়েছি। সন্ধ্যায় একদল তরুণ আইনজীবীর সঙ্গে এই বিচার নিয়ে অনেকক্ষণ একাডেমিক আলোচনা করলাম। আজকের রায়ের সবচেয়ে বড় দিক হলো, ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশে গণহত্যা, মানবতার বিরূদ্ধে অপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ সংঘটিত হয়েছে, আইনগতভাবে তা প্রমাণিত হলো। বিশ্ব ইতিহাসে আজ থেকে এটি লেখা থাকবে, এখন থেকে এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। এত দিন পৃথিবীর মানুষ জানত না, জানলেও আইনগতভাবে স্বীকৃত না হওয়ায় এটা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ ছিল না, আজ অন্তত এই অস্পষ্টতাটুকু দূর হলো।

সবশেষে বাড়ি ফেরার পথে কিছু প্রশ্ন মনে এলো:
১. জামায়াত-শিবিরের হরতাল প্রতিরোধে আমরা কী করেছি?
২. আমার কি ইসলামী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে?
৩. অসুস্থ হলে আমি কি ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে কিংবা ইবনে সিনা হাসপাতাল কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাই?
৪. আমি কি শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টারে আমার সন্তান বা আত্মীয়কে পাঠাচ্ছি?
৫. আমি কি জামায়াত–শিবির পরিচালিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত?

এই প্রশ্নগুলোর, বিশেষ করে ২ থেকে ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে নিজেকে একবার প্রশ্ন করা জরুরি, আমরা কি পরোক্ষভাবে হলেও যুদ্ধাপরাধীপুষ্টদের রাজনৈতিক দল জামায়াত-শিবিরকে সহায়তা করছি না? এসব করে কি আর আমাদের নৈতিক অধিকার থাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে কোনো সমালোচনা করার?

জামায়াত-শিবিরের অর্থনৈতিক ভিত্তি অনেক শক্ত। ধর্মের নামে শুরুতে প্রলুব্ধ করলেও পরবর্তীকালে তারা অর্থ দিয়ে বিশাল ক্যাডার বাহিনী পোষে। আমাদের সবার কি উচিত না জামায়াত-শিবিরের প্রাণভোমরাসম এই অর্থনৈতিক ভিত্তি দৃঢ়তর করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া? এখন সময় এসেছে জামায়াত–শিবিরকে আর্থ–রাজনৈতিক- সামাজিকভাবে বয়কট করার।

জামায়াত-শিবিরকে সব পর্যায়ে ‘না’ বলুন। কেবল সরকার আর আওয়ামী লীগের মুখের দিকে না তাকিয়ে, শুধু ড্রয়িং রুমে বসে তাদের সমালোচনা না করে, আসুন, আমাদের করণীয়টুকু করি।

আইনের মতো আমাদের হৃদয় তো আর অন্ধ নয়। আবেগও সব সময় যুক্তি মানে না। প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের, গণহত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
 



COPY
http://www.natunbarta.com/opinion/2013/02/06/10258/ed9751e642164874f14ef9bec122054c
ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন:
কবি ও আহ্বায়ক জাস্টিস ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড ১৯৭১, অস্ট্রেলিয়া।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন