বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

রাজাকার বাহিনী

ব্রিটিশরা ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখল করে নেয় এবং ১৮৮১ সালে সমগ্র জেলাকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিন সার্কেলে তিন রাজা ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়, বোমাং রাজা অং শৈ প্র“ চৌধুরী এবং মানিকছড়ির মং রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী বা (মং প্রু সাইন )। মানিকছড়ির রাজা ছাড়া অন্য দুই রাজাই ছিলেন যুদ্ধাপরাধী.

চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় রাঙামাটিতে গণহত্যা চলে। এই সময়ে রাঙামাটি মুক্ত করতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র এবং এফ রহমান হলের আবাসিক ছাত্র ইফতেখারসহ ৮-১০ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়।
চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় তার বির্তকিত বই The Departed Melody-তে লেখেন, ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সকালে তিনি (রাজা ত্রিদিব রায়) তার ভগ্নিপতি কর্নেল হিউম, ম্যাজিট্রেট মোনায়েম চৌধুরী, মোঃ হজরত আলী এবং আরো কয়েকজন বাঙালি মুসলিম লীগ নেতাসহ চট্টগ্রামের নতুন পাড়ায় অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেন্টার-এর পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যাজিস্ট্রেট মোনায়েম চৌধুরী এবং রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে আসা আরো কয়েকজন বাঙালি ঢাকা থেকে আসা জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে করে কাপ্তাইয়ে যাবেন। ঠিক সেদিনই বিকেলে কাপ্তাই থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল কয়েকটি লঞ্চ এবং স্পিডবোট নিয়ে রাঙামাটি আসে এবং বিনা প্রতিরোধে দখল করে নেয়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত (ফেব্রু-২০১১) ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস’ বইয়ে জামালউদ্দিন লেখেন, ‘...অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাক দালাল খ্যাত চিহ্নিত এক উপজাতীয় নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) বিশ্বাসঘাতকতায় ঐ দিনই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী রাঙামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়, যা মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সাথে সাথে সেখানে ওৎ পেতে থাকা পাকিস্তানি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এই দলের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইফতেখার।’ [পৃষ্ঠা ৩৭৯-৩৮০]
শুধু রাজা নয়, চাকমা যুবকেরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন এবং সিভিল আর্মড ফোর্স (বা সিএএফ) অথবা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। চাকমা যুবকদের রাজাকার বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রসঙ্গে মে. জে. (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক তার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি প্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি মূল্যায়ন’ বইয়ের ৭৭ পৃষ্ঠায় লেখেন : ‘উপজাতীয় যুবকদের কিছুসংখ্যক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেও অধিকাংশই পকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স বা সিএএফ (রাজাকার বাহিনী হিসেবে পরিচিত)-এ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতায় অংশ নেয়। তৎকালীন রাজাকার বাহিনীতে চাকমাদের সংখ্যাই বেশি ছিল। অনেকেই বেতন এবং অস্ত্রের লোভে সিএএফে যোগ দেয়। রাজা ত্রিদিব রায় তার সার্কেলে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকেন। চাকমা যুককেরা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, পানছড়ি প্রভৃতি এলাকায় স্থাপিত পাকিস্তানি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। উপজাতিদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন রাজশাহী বিভাগ থেকে পালিয়ে আসা ইপিআরের হাবিলদার মি. নলিনী রঞ্জন চাকমা এবং হাবিলদার মি. অমৃতলাল চাকমা। এরা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দোভাষীর কাজও করতেন। উপজাতি যুবকেরা টেনিং ক্যাম্প ৩০৩ রাইফেল, কারবাইন, স্টেনগান, এল এম জি চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতেন।’ আফসান চৌধুরী লিখেছেন (বাংলাদেশ ১৯৭১ : প্রথম খণ্ড, ফব্রে“. ২০০৭, মাওলা ব্রাদার্স, পৃষ্ঠা ৪৩২) : ‘আদিবাসী অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে মিজো এবং চাকমা আদিবাসী পাকসৈন্যদের সাহায্য করে’
এই যুদ্ধাপরাধীদের বংশধররা বংশপরম্পরায় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে আসছে। বর্তমান আমরা তাদেরই আবার দেশের প্রতিনিধি বানিয়েছি বিশ্বদরবারে, জাতিসংঘে। যুদ্ধাপরাধী চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় এবং বিচারপতি সায়েমের উপদেষ্টা ত্রিদিব রায়ের মা বিনীতা রায়ের বংশধর এবং উত্তরাধিকারী দেবাশীষ রায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজামী ও মুজাহিদের মতো তার গাড়িতেও বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। তিনি সম্প্রতি মেক্সিকোর কানকুনে শেষ হয়ে যাওয়া জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের পক্ষে কাজ করেছেন। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংগঠন ইউএনএফসিসিসি (UNFCCC) এবং ইউ এন পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইনডিজিনাস ইস্যুর বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। (সূত্র : প্রথম আলো, ০২ জানুয়ারি ২০১১)
রাজাকার ফজলুল কাদের চৌধুরীর পুত্র হিসেবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যদি ওআইসির (ঙওঈ) মহাসচিব পদের জন্য নির্বাচন করে দেশের ভাবর্মূতি নষ্ট করতে পারে তাহলে কেন ত্রিদিব রায়ের মতো প্রমাণিত রাজাকারের পুত্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে? এখন তো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত সরকার। তাদের অপরাধের কেন বিচার হবে না?
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র সরাসরি অংশগ্রহণকারী মানিকছড়ির মং সার্কেলের রাজা মং প্রু চাঁই চৌধুরী বা (মং প্রু সাইন) মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে তিনি প্রায় সর্বস্বান্ত হন। স্বাধীন দেশে এ রাজার কোনো উপাধি মিলেনি। তিনি বা তার উত্তরাধিকারীরা দেশের উপদেষ্টা বা বিশ্বের দরবারে দেশের প্রতিনিধি হতে পারেননি। জাতিসংঘে কোনো বিষয়ে প্রতিনিধি হতে পারেনি। অথবা জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হতে পারেনি স্বাধীনতাযুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে অংশগ্রহণকারী কোনো উপজাতি যোদ্ধা। (সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন