বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণ

জামাত নেতা নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণ করতে সংগঠনটির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। বর্তমানে আটক এ ৫ জনের বিরুদ্ধে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলছে তদন্তকার্যক্রম।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দলিল (ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান) অনুযায়ী এবং ওই সময় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জামাতের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, চার নায়েবেÑ আমির মওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, মকবুল আহমাদ, মওলানা আবদুস সুবহান, মওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, তিন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলÑ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ও এ টি এম আজহারুল ইসলাম, নির্বাহী পরিষদের অপর দুই সদস্যÑ আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের ও মীর কাসেম আলী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেন। তারা ঘাতক রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনী গঠনে সহায়তা করেন। এসব বাহিনীর নেতৃত্বও দেন তারা।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, একাত্তরের ১৪ জুন জামালপুর ইসলামি ছাত্রসংঘের এক সভায় নিজামী বলেছিলেন, ইসলাম রক্ষায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এজন্য তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। জামাতের দলীয় মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় নিজামীকে বদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে উল্লেখ করা হয় (মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক সংগ্রামের ভূমিকা)।

পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় নিজামী বলেছিলেন, ‘ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীরা দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি রক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ (দৈনিক সংগ্রাম, ৮ সেপ্টেম্বর)।

আজাদি দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে

নিজামী বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান কোনো ভূখণ্ডের নাম নয়, আদর্শের নাম। ইসলামি আদর্শই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে এবং এ আদর্শই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ইসলামপ্রিয় ছাত্রসমাজ বেঁচে থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকে থাকবে’ (১৫ আগস্ট ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)।

জামাতে ইসলামীর বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন আল-বদর বাহিনীর অন্যতম সংগঠক। ১২ আগস্ট ১৯৭১ দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এর উল্লেখ রয়েছে। ’৭১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরে ইসলামি ছাত্রসংঘের এক সভায় মুজাহিদ আল-বদর বাহিনী গড়ে তুলতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন। ২৫ অক্টোবর ইসলামি ছাত্রসংঘের এক সম্মেলনে মুজাহিদ ‘পাকিস্তানের ছাত্র-জনতাকে দুষ্কৃতকারী (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান’ (২৬ অক্টোবর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)।

১৯৭১ সালের বদর দিবস উপলক্ষে ৭ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে ঢাকা শহর ছাত্রসংঘ আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় মুজাহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু কিছু লোক এখনো পাকিস্তানের আদর্শবিরোধী কাজ করছে। জনগণ তাদের সম্পর্কে সচেতন।’ তিনি এদের খতমের আহ্বান জানান (৮ নভেম্বর ১৯৭১ দৈনিক আজাদ)। তিনি ওই সমাবেশে যেসব দোকানে ‘ভারতমনা’ লেখকের বই পাওয়া যাবে সেগুলো জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।

জামাতের নায়েবে আমির মওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মালেক মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। মালেক মন্ত্রিসভার এ মন্ত্রীর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল মন্ত্রী হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। প্রায় দুবছর সাজাও ভোগ করেন তিনি। দালাল আইন বাতিল হলে ১৯৭৪ সালে তিনি মুক্তি পান। ১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী সড়কের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামাতকর্মী নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করেন ইউসুফ। তখন এ সংবাদ দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ছাপা হয়। ২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সঙ্গে কঁাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবিলা করছে। তিনি রাজাকারদের হাতে আরো আধুনিক অস্ত্র দেয়ার দাবি জানান।

জামাতের আরেক নায়েবে আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে স্বাধীনতার বিরোধিতা করার অভিযোগ। মকবুল আহমাদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় শান্তি কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন (মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, পৃ-৪৩০)। মকবুল আহমাদ ’৭১ সালের ১০ আগস্ট রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রামের ডিউটি অফিসার ইনচার্জ ফজলুল হককে লেখা এক চিঠিতে ফেনীর তাকিয়াবাড়ির মওলানা সৈয়দ ওয়ায়েজ উদ্দিনকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। এজন্য তিনি ফেনী শহর রাজাকার কমান্ডার হানিফ ও উপদেষ্টা মওলানা মোস্তফাকে চট্টগ্রামে পাঠান। পরে ১৭ আগস্ট চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে ওয়ায়েজ উদ্দিনকে একটি জিপে করে তুলে নিয়ে যায় রাজাকাররা। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মকবুল আহমাদের হাতে লেখা সেই চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করে বিলি করে। (তথ্য সূত্র : ফেনী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সংবাদ)।

জামাতের আরেক নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীও একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি স্বাধীনতার প্রবল বিরোধিতা করেন। মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিলেন বলেও স্থানীয় লোকজন ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এ অভিযোগ এনেছেন। যা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

জামাতের অপর নায়েবে আমির মওলানা আবদুস সুবহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা জেলা শান্তি কমিটির প্রধান ছিলেন। ‘একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান’ বই দুটিতে এর উল্লেখ রয়েছে। মওলানা সুবহানের সেই সময়কার কোনো বক্তব্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে খুঁজে পাওয়া না গেলেও তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।

জামাতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতি আশরাফ আলীর তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে আল-বদর বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামের একটি প্রতিবেদনে কামারুজ্জামানকে ময়মনসিংহ জেলা আল-বদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের খবরে বলা হয়, জেলা ছাত্রসংঘের নেতৃত্বে আল-বদর বাহিনী জামালপুরে মোট ৫০০ দুষ্কৃতকারীকে (নিরীহ গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধা) হত্যা করেছে। সেই সঙ্গে চার ভারতীয় চরকে আটক করেছে। ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আটক করার খবরও প্রকাশ করা হয়।

অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম আল-বদর বাহিনীর রাজশাহী জেলা শাখার প্রধান ছিলেন (মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান পৃ-৪৩০)। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর রংপুরের যে সভায় মুজাহিদ আল-বদর বাহিনী প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন, সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন দলিল ‘ফোর্টনাইটলি সিক্রেট রিপোর্ট অন দ্য সিচুয়েশন ইন ইস্ট পাকিস্তান’-এর অক্টোবরের দ্বিতীয় ভাগের প্রতিবেদনে (১৩ নভেম্বর ১৯৭১ স্বরাষ্ট্র সচিব স্বাক্ষরিত) এ সভার কথা উল্লেখ আছে।

আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান পৃ-৪৩০)। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জামাতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিকবার টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এর উল্লেখ রয়েছে।

নির্বাহী পরিষদের সদস্য আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের ’৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামি ছাত্রসংঘের সভাপতি ও চট্টগ্রাম বদর বাহিনীর জেলাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন (মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, পৃ-৪২৯)। ২ আগস্ট চট্টগ্রামের মুসলিম হলে এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘ভারতের সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাবো।’ (৩ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম)

নির্বাহী কমিটির আরেক সদস্য মীর কাসেম আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে ঢাকা শহর ছাত্রসংঘের আয়োজিত সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘১৪শ বছর পূর্বে কাফেররা রাসুলুল্লাহর (সা.) ওপর যেভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল হিন্দুস্তান (ভারত) ও তার চররা (মুক্তিযোদ্ধারা) বর্তমানে পাকিস্তানের ওপর সেভাবে হামলা চালাচ্ছে। আমাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত থাকতে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে হিন্দুস্তানের গোলামে পরিণত হতে দেবো না।’ (দৈনিক আজাদ ৮ নভেম্বর ১৯৭১)।

সূত্র জানায়, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী, আর তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আল-বদর নরহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালিয়েছিল এ দেশে। আর এ কাজে নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লা কোথাও ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করার, আবার কোথাও পথপদর্শক হিসেবে কাজ করার তথ্যপ্রমাণ আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে। যাচাই-বাছাই করে সাক্ষ্যপ্রমাণকে আরো সুনির্দিষ্ট করতে প্রত্যেকটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে তদন্ত সংস্থা।

তথ্য সূত্র:ভোরের কাগজ ১৪ আগস্ট ২০১০
ভোরের কাগজ ১৪ আগস্ট ২০১০
বিঃদ্রঃ -যে সমস্ত ব্লগার বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশ্বাস করেনা, মুক্তিযুদ্ধকে বলে গন্ডোগোল, যারা ধর্ম ব্যাবসা করে মানুষদের রাজনীতির নামে বিভক্ত করে, যারা স্বাধীন বাংলাদেশ কে এখনো পাকিস্তানের কলোনী ভাবে ও গোলাম আজম-নিজামী-সাঈদী -মুজাহিদকে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে মনে করেন তারা আমার পোষ্টে কমেন্ট করবেন না প্লিজ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন